Saturday, May 11, 2013




                                  *    দিলীপকান্তি লস্কর  *  

 
                                                                     
উনিশের ভাষাসংগ্রাম তার প্রকৃত ইতিহাসের নিরিখে, বৈচিত্রে ও ব্যাপকতায় এ-যাবত সংঘটিত বিশ্বের সব ভাষা আন্দোলনের চেয়েও বোধকরি শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে৷ উনিশের ভাষাসৈনিকেরা ছিলেন দেশপ্রেমীর আদর্শ, ফলে উনিশের মধ্যে কেবল ভাষিক স্বাধিকার ছাড়া কোনও পৃথকতার অভিপ্রায় ছিল না৷ ভাষাতাত্ত্বিক গণ-অভু্যত্থানের এমন আপামর ব্যাপ্তি আর একটি ক্ষেত্রেও বোধহয়় নজরে পড়ে না৷
কলকাতা, ঢাকা, জার্মানি, ফ্রান্স, লন্ডনবাঙালি বিশ্বের প্রায় সর্বত্র সাড়া জাগিয়েছিল এই উনিশে মে৷ সত্যাগ্রহের অভিনব পন্হা-প্রকরণে, গণ-সত্যাগ্রহের ব্যাপকতায় এবং শহিদ শব-মিছিলের বিশালতায় সেকালের তুলনায় নজিরবিহীন সংখ্যক লোকের অংশগ্রহণ এবং সবোর্পরি অধিবাসীদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় ১০০শতাংশেরই সমর্থন ও অধিকাংশেরই প্রত্যক্ষপরোক্ষ অংশগ্রহণ তথা স্বতস্ফূর্ত জনোচছ্বাসে এ এক অনন্য সংগ্রাম৷ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে হাসপাতালের সিভিল সার্জেন পর্যন্ত প্রায় সর্বস্তরের সমস্ত পেশার মানুষই এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ আর সেই অংশগ্রহণ এতই জোরালো ছিল যে, তা গোটা প্রশাসনকে প্রায় মাসাধিককাল ধরে অচল করেই রেখেছিল৷ সবরকম বলপ্রয়োগ করেও একটি শহিদ-শবও গুম করতে পারে নি প্রশাসন৷ অসংখ্য পুলিশ মিলিটারি প্রয়োগ করেও সফল করতে পারে নি কারফিউ বা ১৪৪ধারা৷ মূলত বাংলাভাষার স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম হলেও এই সংগ্রামে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন পাহাড় ও সমতলের অবাঙালি জনগণএঁদের কেউ কেউ দিয়েছেন কম-বেশি নেতৃত্বও৷ তুলনা করা যায় উনিশের এইসব স্বভাবধর্ম বা উপাদান উপাদান বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বিশ্বের অন্য কোনও সংগঠিত ভাষা সংগ্রামের?–না, এ অনন্য, এ অতুলনীয়৷
প্রশ্ন ওঠে এ-হেন মহান উনিশকে অনেকেই জানেন না কেন? এর প্রথম কারণ, বাঙালি মূলত এক আত্মবিস্মৃত জাতি৷ দ্বিতীয়ত, উনিশের পূর্ণ পরিচায়ক কোনও নথিবহুল ইতিহাস নেই৷ আজকের যুগের কোনও ইতিহাসেরই শুধু শ্রুতি, মিথ বা গাথা হয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়৷ তৃতীয়ত, উনিশের অকুস্থলের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থান৷ সেই ব্রিটিশ শাসনের কাল থেকেই বেনে জাতির বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রশাসনিক টানাহঁ্যাচড়া, বঙ্গভঙ্গ ও পরিশেষে দেশভাগের অভিশাপ বুকে নিয়ে মূল বঙ্গভূমি থেকে বিচিছন্ন ও বিক্ষিপ্ত যে ভূখণ্ডটি ভারতের এক ত্রিশঙ্কু অবস্থানে পড়ে আছে, সেই বরাক উপত্যকা (পূর্বের অবিভত্তু কাছাড়)-ই উনিশে মে-র অকুস্থল৷ প্রশাসনিক দিক থেকে এই বিক্ষিপ্ত বঙ্গভূমিটি আসাম রাজ্যের অন্তর্গত হওয়ার দোষে প্রবাস-বঙ্গ তো বটেই়, সদর-বঙ্গ (পশ্চিম) ও বাংলাদেশের কাছেও যেন অনেকটা হারিয়ে যাওয়া অনাথের মতোই অস্তিত্ব৷ আসামের বাঙালিদের অনেকেই এখনও অসমিয়া বলেই ভাবেন এবং তাদের বাংলাভাষায় কথা বলার গুণকে বিস্ময়ে তারিফ করেন৷ এই আমাদের নিয়তি৷ এই নিয়তির জন্যই শিলচর কখনওই ঢাকা বা কলকাতার মতো গুরুত্বের সঙ্গে উচচারিত হতে পারে না৷ ফলে ঘটনার মাহাত্ম্য যাই থাকুক না-কেন, প্রচারের সুযোগ সীমিত৷ চতুর্থত, উনিশের অকুস্থল কোনও স্বাধীন দেশ নয়, কোনও পৃথক রাজ্যের লক্ষ্যেও নিয়োজিত হয়নি৷ ফলে একুশে ফেব্রুয়ারির মতো উনিশে মে-র উত্তরাধিকারে নেই কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্র, বরং ভিনভাষী রাজ্যে উনিশে সর্বপ্রকার অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার৷ এই চারটি কারণের প্রথমটি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করার কোন সাধ্য নেই আমাদের৷ আমরা উনিশের ইতিহাস চর্চা করা এবং করানোর মাধ্যমেই কেবলমাত্র সম্ভব করে তুলতে পারি উনিশের প্রেরণা ও চেতনার প্রচার৷
কিন্তু উনিশের ইতিহাস রচনায় রয়েছে বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা৷ প্রথমত, বরাকে সরকারি কোনও সংগ্রহশালা এখনও নেই৷ করিমগঞ্জ, কাছাড় ও হাইলাকান্দিএই তিনটি জেলায় তিনটি জেলা গ্রন্হাগার আছে বটে, কিন্তু সেখানে বাংলা বই খুব কম৷ ফলে এতগুলি দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর নথিপত্র সংগ্রহের জন্য প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, এখনও৷ যাঁরা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা মূলত ভাষাপ্রেমী সৈনিক৷ ইতিহাস সংরক্ষণের চিন্তা তাঁদের মাথায় ছিল না৷ আর, যাঁরা সংরক্ষণ করেছিলেন, তাঁরা সকলেই পরলোকগত, তাঁদের উত্তরাধিকারীরা ভাষাসংগ্রামের উত্তরাধিকারী নন, ফলে পুরনো কাগজ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেন নি৷ কারও কাগজপত্র ইঁদুরে, কারও বন্যায়, কারও বারবার বাড়ি বদলের ফলে নষ্ট হয়ে গেছে সমস্ত মূল্যবান কাগজপত্র৷ বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রয়াত ড. দেবব্রত দত্তের সংগৃহীত লন্ডন টাইমস-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের উনিশের প্রতিক্রিয়া-সংক্রান্ত সংবাদপত্রের কাটিংস ও অন্যান্য নথিপত্র গৃহ পরিচারিকা তাঁর অনুপস্থিতিতে কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছিল৷ শেষ হয়ে গিয়েছিল একজন ঐতিহাসিকের দ্বারা ভারতে বাংলাভাষা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস প্রণয়নের সম্ভাবনা৷
দ্বিতীয়ত এর পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকের সমস্যা৷ উনিশের ইতিহাস রচনায় কিন্তু ঐতিহাসিকরা কেউ এগিয়ে আসেন নি৷ যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত৷ তাঁরা সম্পূর্ণ স্বকীয়ভাবে এই মহাসংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন৷ বিস্তৃত ইতিহাস যে-দুজন লিখেছেন, তাঁরা হলেন ড. সুবীর কর (বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক), ডাঃ কানু আইচ (চিকিৎসক)৷ এঁরা কেউ ঐতিহাসিক না হয়েও উনিশের সুবিন্যস্ত ইতিহাস লিখতে প্রয়াসী হয়েছেন৷
উনিশ কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পিছনে আরও দুটি-একটি কারণ আছে৷ যেমন, উনিশে মে ১৯৬১-র ভাষাসংগ্রামে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট উভয় দলেরই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল৷ স্বাভাবিকভাবে দুই দলের ভূমিকা নিয়ে পারস্পরিক চাপান-উতোরও ছিল, এখনও আছে৷ ঐতিহাসিকেরা কোনও পক্ষ নিলে ইতিহাস কখনও নিরপেক্ষ হতে পারে না৷ একপক্ষের সমর্থক হলে অন্য পক্ষ থেকে সমর্থন তো পাওয়া যায়ই না, বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়৷ এই ব্যাপারটিও অনেক ঐতিহাসিককে কাজ থেকে বিরত রেখেছিল৷ এ ছাড়া, আর একটি প্রতিবন্ধকতা হচেছ গৃহশত্রুতা৷ ভাষাসংগ্রামের এককালের কুশীলব পরবর্তীকালে দালালিবৃত্তিকে জীবিকা করে চলতে গিয়ে অনেককেই খুশি করতে চেয়েছেন, ফলে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে৷ এই বিকৃতিকেই অনেকে সত্যবলে চালিয়ে যাচেছন দীর্ঘকাল৷ উনিশের ইতিহাস বিষয়ে আর একটি সমস্যা, যা খুবই প্রাসঙ্গিক, তা হচেছ স্মৃতিচারণের সমস্যা৷ দীর্ঘ কাল-পরিসরে সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতি বয়সোচিত কারণেই ঝাপসা হয়ে গেছে৷ আবার কেউ কেউ নিজের মনগড়া ঘটনা সাজাতেও ভালবাসেন৷ আবার বিশিষ্ট কিছু রাজনৈতিক নেতা তাঁদের দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে কোনও অবোধ্য কারণে তাঁদের স্মৃতিকথা লিখতেই নারাজ৷ এতেও ইতিহাসে অপূর্ণতা থেকে গেছে৷
এখানে একটি তথ্য দিই৷ ১৯ মে-র ১১ শহিদের সঙ্গে বুকে গুলি নিয়ে কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস  ২৪ বছর ধরে অসুস্থ থাকার পর মারা যান৷ তাঁকেও আমরা অবশ্যই ভাষাশহিদের মর্যাদা দেব৷ তাই এখন থেকে আমরা উনিশের ভাষাশহিদ একাদশ নয়, দ্বাদশ বলব৷ আবার উনিশের ভাষাশহিদদের স্মরণ শুধু উনিশের দ্বাদশ শহিদের স্মরণেই সমাপ্য নয়৷ মূল বঙ্গ-ভূখণ্ড থেকে বিচিছন্ন বরাক উপত্যকার রত্তেুর বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষার অধিকার বারবার প্রশাসনিক দুরভিসন্ধি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং পুনঃপুন অনিবার্য হয়ে উঠেছে মাতৃভাষা সংগ্রাম৷ ফলে বাংলাভাষার জন্য ফের রত্তু দিতে হয়েছে দু-বার, ১৯৭২ এবং ১৯৪৬-তে৷ শহিদ হয়েছেন যথাক্রমে একজন এবং দু-জন৷
এ-হেন পরিস্থিতিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বর্তমান প্রতিবেদক সম্পাদিত লালনমঞ্চ-এর বিশেষ দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় গত শতকের শেষে৷ যার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৩৫০। পরবর্তিকালে খণ্ডে খণ্ডে সেগুলি গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হয়৷ বলা বাহুল্য, গ্রন্হপ্রকাশের কিছুকাল পরেই তা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়৷ তাও অনেক বছর হয়ে গেল৷ কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় ব্যত্তিুগত উদ্যোগে একসময়ে যে-কাজ হয়েছে, পুনর্ুদ্রণের প্রশ্নে এখন আর তা সম্ভব নয়৷ তবে ব্যত্তিুগত কোন স্বার্থ নয়়, উনিশের সত্যিকারের ইতিহাস যদি আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হয়, তাহলে এই গ্রন্হটি পুনঃপ্রকাশে কোন বড় প্রকাশনীর এগিয়ে আসা উচিত৷ কেন না, ১৯ মে ১৯৬১, ১৭ আগস্ট ১৯৭২ এবং ২১ জুলাই ১৯৮৬এই তিন-তিনটি ভাষাসংগ্রাম সংঘটিত হওয়া এবং বরাক উপত্যকার বাঙালির অস্তিত্বের সংকটটি কোথায়, তার সঠিক উন্মোচন যেমন হয়েছে, তেমন তার বহুল প্রচারও প্রয়োজন৷